বাংলাদেশে কমিউনিজম আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়...???
এর কারণ হিসেবে রয়েছে তথাকথিত বামপন্থীরা, যারা এখনো বুঝেন না মার্কসবাদের অ, আ, ক, খ.... যারা মার্কসবাদ ও কমিউনিজমের মুখোশ পড়ে পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলছেন সাধারণ মানুষের চোখে ধুলা দিয়ে...
মোকাবিলা : ফরহাদ মজহার
প্রকাশক : বাঙলায়ন
প্রচ্ছদ : অস্ট্রিক আর্যু
মূল্য : ১২৫ টাকা
লেখক পরিচিতি :
ফরহাদ মজহার
জন্ম : ১৯৪৭ নোয়াখালী
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা : ঢাকা ও নিউইয়র্ক, ঔষুধশাস্ত্র ও অর্থনীতি
ফরহাদ মজহার, কবি নামে খ্যাত কিন্তু কাজ করেন বিজ্ঞান ও আর্থ-সামজিক গবেষণার নানা ক্ষেত্রে। কাব্যের সাথে বিজ্ঞান, রাজনীতি ইত্যাদির ভেদ খুব একটা মানেন না। নেশা কৃষি ও ভাব চর্চা। নয়া কৃষি আন্দোলনের মধ্যদিয়ে কৃষি বা প্রকৃতি আর নবপ্রাণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার সাধক ধারার ভাব চর্চা। সে কারণেও কখনো বিজ্ঞান, কখনো গান, কখনো কাব্য। ভাবুকতা সব সময়ই সঙ্গী। কারণ নতুন সম্ভাবনা প্রতিশ্র“তি পালন ও পরিবর্তনের জন্যই তো ভাব। দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় তার রাজনৈতিক দার্শনিক লেখালেখির সাথে পাঠকেরা পরিচিত। গল্প করতে আর আড্ডা দিতে ভালবাসেন। কথা বার্তার মধ্যেই তত্ত্ব চর্”া হয় যদি কাজের সাথে যোগ থাকে। কিভাবে দর্শন বা ভাবকে তিনি জীবন চর্চার অংশ করে ফেলেন আর বিপ্লবী রাজনীতির ক্ষেত্রকে ক্রমাগত স্বপ্রাণ ও বিস্তৃত করে তোলেন এই বইটি তার স্বাক্ষী।
উৎসর্গ :
ধর্মবোধ যে কখনো কখনো শোষণের খোলস ছেড়ে শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করতে পারে তার আদর্শ নজির মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। কৃষিজীবী মানুষের নীতিনৈতিকতা সমগোত্রীয়তা ও জীবন যাপনের ভাষায় ধর্মীয় পরিভাষার শক্ত শিকড় থাকলে, কৃষিজীবি মানুষের সংগ্রামের ধরণ বুঝতে হলে ধর্মের সাথে মানুষের সম্পর্ককে ঐতিহাসিক বাস্তবতার ও ধারবাহিতকার প্রেক্ষাপট থেকে বুঝতে হবে। এই দিক থেকে মাওলানা ভাসানী আমাদের কৃষিজীবী মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস ধারণ করে রপ্ত করেছিলেন সংগ্রামের এমন এক ভঙ্গি যা ধর্মের আবরণেও ধর্মীয় নয়। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই অভিনব কায়দাকে আয়ত্ত্ব করতে ভাসানীকে পুনর্পাঠের অপরিহার্যতা বোঝা যায় লেখকের বইটি মাওলানা ভাসানীকে উৎসর্গে।
বই পর্যালোচনা :
মোকাবিলা বইয়ে বিপ্লবী রাজনীতিকে কিভাবে ধর্মের সাথে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে ফরহাদ মজহার তা বিস্তৃত ভাবে তুলে ধরেছেন ১৪ টি প্রবন্ধের মাধ্যমে।
তিনি বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতির ব্যর্থতার পিছনে ধর্ম ও সমাজতন্ত্রকে মিলিয়ে ফেলার বিষয়কে অভিযুক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের মানুষ সমাজতন্ত্র বললেই নাস্তিকতা বুঝে নেয়। প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্র মানেই নাস্তিকতা নয়। ধর্মের সাথে সমাজতন্ত্রের কোন বিরোধ নেই। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন ও হেগেলের বিভিন্ন লেখা বিশ্লেষণ করে লেখক দেখিয়েছেন কিভাবে বিপ্লবী রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মকে মোকাবিলা করতে হয়।
বিপ্লবী রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ কার্ল মার্কস কখনো বলেননি যে বিপ্লবী রাজনীতিবিদগণ তাদের নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে না। বরং পুঁজিবাদীরা সমাজতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য মার্কসের কথাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করেছেন। লেখক দেখিয়েছেন পুঁজি কিভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে স্বীয় স্বার্থ হাসিল করে। যেমন পুঁজির পতাকাধারী বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের খেয়ালখুশি মতো ইসলামের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দেয়। দাবি করে এই হচ্ছে সত্যিকারের ইসলাম । এর ফলে আমরা এক বিচিত্র ইসলামকে দেখি, যেখানে সুদ খাওয়া হারাম নয়। শুধুমাত্র "সুদের" নাম পরিবর্তন করে "সেবা" বললেই হয়।
পুঁজি আমাদের শেখায় যদি বিষ বেচে মুনাফা হয় তাহলে বিষই অমৃত। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজি মানুষের উৎপাদন, ভোগ, বিতরণ ও বিনিময় জীবন যাপনের মূল কর্তাস্বত্তা , জীবনের কারণ পদার্থ। আল্লাহ যেখানে মানুষের রিযিক নিশ্চিত করার দাবি করে ইহলোকে পুঁজিই তা নিশ্চিত করতে পারে। এটা প্রমাণ করাই পুঁজির কাজ হয়ে উঠছে। সে নিজেকে আল্লাহর সাথে স্থাপন না করে নিজের পুঞ্জিভবন, স্ফীতি ও বিস্তার নিশ্চিত করতে পারে না। আল্লাহকে তার আরশ থেকে না সরিয়ে পুঁজি সেই আরশে বসে কি করে ? তাই বলা যায় একালের আস্তিকতা নাস্তিকতা লড়াইয়ের বৈশ্বয়িক ভিত্তি পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত।
ফরহাদ মজহারের ভাষায়, পুঁজি যেমন করে মানুষকে তৈরী করে ; মানুষের ভাব, ভাষা , চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘুমানো নিয়ন্ত্রণ করে ; এই নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলিত জীবনকেই পুঁজি মুক্ত জীবন বলে ঘোষণা করে।
আর মানুষের স্বাধীনতা মানে পুঁজির বাজারে যা খুশি কেনার স্বাধীনতা। তিনি আরও বলেন, পুঁজি মানুষের মনের সকল পর্দা খসিয়ে দেয়। দেখা যায় নির্বিকার নগদ টাকার বাঁধন ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই। কিছুই বাকি রাখেনি পুঁজি।
মোকাবিলা গ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রকাশের পর বিপ্লবী রাজনীতির সাথে ধর্মের তালাক যেন চিরকালের জন্যই হয়ে গিয়েছিলো। আর এই তালাকটা হয়েছিলো মার্কসের বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার জন্য। পুঁজিবাদীরা তাদের স্বীয় স্বার্থের জন্য মার্কসের বক্তব্যের বিকৃতি ঘটায়। ফরহাদ মজহার বলেন, আশার কথা গত কয়েক বছরে মার্কসের অনুসারীরা ধর্মের মোকাবিলার ক্ষেত্রে বেশ সচেতন হয়েছেন। হয়তো রাজনৈতিকভাবে মার খাওয়ার কারণে কিংবা বাস্তব জগতে পা দেয়ার জন্য।
এই গ্রন্থে ফরহাদ মজহার দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কমিউনিজম মানেই নাস্তিকতা নয়। মার্কস সে কথা কখনোই বলেন নি। এটা কমিউনিজমকে ধ্বংস করার জন্য পুঁজিবাদীদের বিকৃত উপস্থাপনা। ধর্ম হচ্ছে জনগণের জন্য আফিম - এই তত্ত্বই এতকাল মার্কসের নামে ফেরী করা হয়েছে। এই ধরণের স্থূল মন্তব্য প্রসঙ্গহীনভাবে সামনের কথা ও পেছনের ব্যাখ্যা কাঁটছাট করে মার্কসের লেখা বলে প্রচার ছিল সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির অংশ। এক্ষেত্রে মাকর্সবাদীদেরও তিনি সমান অপরাধী বলে অভিযোগ করেছেন। কারণ সেই রসদ প্রতিপক্ষের হাতে মার্কসবাদীরাই তুলে দিয়েছে এবং এদের প্রতিবাদ না করে নীরবে সহ্য করেছে। অনেকে আবার এ সম্পর্কে ভালো মতো না জেনেই গ্রহন করেছেন। কমিউনিস্ট মাত্রই নাস্তিক এই প্রমাণের মধ্যদিয়ে সেই আঁতাত স্নায়ুযুদ্ধের সময় অতি সহজেই গড়ে তোলা হয়েছিলো এবং কমিউনিস্ট নিধনে মার্কসবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা হাত মিলিয়েছিলো।
কিন্তু ধর্ম জনগণের জন্য আফিম কথাটার অন্তরালে মার্কস যা বলেছেন, তা হলো আফিম যেমন কোন অসুখের সমাধান দিতে পারে না শুধু সাময়িক বেদনা উপশম করতে পারে মাত্র। ঠিক তেমনি ধর্মও কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে না শুধুমাত্র সাময়িক ভাবে ব্যথা থেকে মুক্তি দিতে পারে । তবে নিশ্চয়ই তা স্থায়ী নয়। সে জন্য তিনি ধর্মকে পর্যালোচনার কথা বলেছেন। ধর্মকে বাদ দিতে বলেননি। আর এটাকেই অনেকে না জেনে ধর্মহীনতা বলে চালিয়েছে। পেটি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের অন্ত:সারশূন্য আত্মম্ভরিতার কারণেই ধর্ম জনগণের জন্য আফিম কথাটার প্রকাশ পায়।
ধর্মের বিচার কিভাবে করতে হবে মার্কস ,এঙ্গেলস বা লেনিনের বিস্তর লেখায় তার বহু গুরুত্বপূর্ণ ঈঙ্গিত, ইশারা ও সরাসরি বিশ্লেষণ ও প্রস্তাবনা আছে, একটু কষ্ট করে পাতা উল্টালে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেই কাজ আজ অবধি হয়নি। কেউ যদি ধনী হয় তাহলে আল্লাহ করেছে বলা হয়, তেমনি কেউ যদি গরিব হয় সেটাও আল্লাহারই কর্ম। তাহলে ধনীর বিরোধিতা করা আর গরিবের পক্ষে সংগ্রাম করা মানে চরম অধার্মিকের পরিচয় দেওয়া। ধর্ম তো তা বরদাশত করে না। ধর্মের এই দিকটা দৃশ্যমান করার জন্য মার্কসকে বলতে হয়েছে ধর্ম জনগণের জন্য আফিমের মতো। ধর্ম সম্পর্কে কমিউনিস্টদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে মার্কসের এই মন্তব্যটার সঙ্গেই আমরা বিশেষভাবে পরিচিত। কারণ এই
মন্তব্যের সূত্র ধরেই ধর্মবাদীরা প্রবলভাবে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়েছে। এখনও লড়ে এবং ঐতিহাসিকভাবে খেটে খাওয়া রাজনৈতিক সংগ্রামকে পর্যুদস্ত করতে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী আজ অবধি অতিশয় সফল হয়েছে। অথচ এটা মার্কসের বাহ্যিক ও গৌণ মন্তব্য। আর এটিকে পুঁজি করে পুঁজিবাদীরা কমিউনিজম কে ধ্বংস করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছে।
পুঁজিবাদীদের এই কূট-কৌশল বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশে কমিউনিজমের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা ধর্মকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। একটু সর্তক হয়ে ধর্মকে মোকাবিলা করতে পারলে কমিউনিজম বাংলাদেশে শক্তিশালী ভিত্তিতে দাঁড়াতে পারতো। কমিউনিজম এর সাথে মূলত ধর্মের কোন বিরোধ নেই। কমিউনিষ্টরা ধর্ম পালন করতে পারবে না- মার্কস কখনও এরকম কথা বলেননি। কমিউনিজম মানেই যে নাস্তিকতা নয় বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। ফরহাদ মজহার বলেন, এদেশের কমিউনিজমের আন্দোলন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। ধার্মিক হয়েও আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কমিউনিজম করে গেছেন। এটা প্রমাণ করে যে ধর্ম ও কমিউনিজমের মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
পুঁজিবাদীরা ধর্মকে কমিউনিজমের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে কমিউনিজম ভীতি সৃষ্টি করেছে। ফরহাদ মজহারের মতে, মার্কস ও এঙ্গেলস এর রচনা থাকা স্বত্বেও ধর্ম মাত্রই নির্যাতনমূলক শোষণের হাতিয়ার বাংলাদেশের তথাকথিত গণতন্ত্রী বা প্রগতিশীলদের মধ্যে এই বিকৃত চিন্তা কিভাবে এতো গভীরে প্রোথিত হতে পারল সেটা সত্যিই ভাববার বিষয়। কী করে প্রগতিশীলতার অর্থই হচ্ছে খেয়ে না খেয়ে যা কিছুই ধর্মমূলক তার বিরোধিতা করা - এই প্রকট অসুস্থতা কিভাবে আমাদের ছেয়ে ফেলতে পারল? যার কারণে দাড়ি, লুঙ্গি ও টুপি ওয়ালা মানুষকে রাজাকার ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারিনা। যদি দয়া করে তাকে রাজাকার গণ্য না করি নির্ঘাত তাকে পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল ছাড়া আর কিছুই ভাববার নজির আমরা তথাকথিত প্রগতিশীলদের মধ্যে দেখিনা।
ফরহাদ মজহার দেখানোর চেষ্টা করেছেন, মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের চিন্তার সঙ্গে এসকল স্বঘোষিত গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বা কমিউনিস্টদের কোন মিল নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন "সৌভাগ্যক্রমে আজকাল নাস্তিক হওয়া সহজ¬ই" (মার্কসÑ এঙ্গেলস ১৯৮১, পৃঃ - ১৪১)।
লেনিনের একটি উদ্ধৃতি হলো "যে নৈরাজ্যবাদী খেয়ে না খেয়ে আল্লা-খোদার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ওয়াজ করে বেড়ায়, সে আসলে মোল্লা-মৌলবী পুরোহিত আর বুর্জোয়াদের স্বার্থই রক্ষা করে" (লেনিন ১৯৭৩, পৃঃ ৪০৭)।
ফরহাদ মজহারের মতে, বাংলাদেশে কমিউনিজম সম্পর্কে প্রচণ্ড ভুল ধারণা রয়েছে। সেটা হল কমিউনিজমে আল্লা-খোদা নেই, ধর্ম নেই। কমিউনিজমের গোঁড়া সমাজে আল্লার কোন অস্তিত্ব থাকবে না, আল্লার দ্বীন পালন করা যাবে না। দ্বিতীয় ভুলটা হচ্ছে, কমিউনিজমের সাথে নানা রঙ্গের নাস্তিকদের গুলিয়ে ফেলা। বিষয়টি এরকম পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কমিউনিস্ট মানে নাস্তিক, নাস্তিক মানেই কমিউনিস্ট। স্নায়ুযুদ্ধের কালপর্বে বিশেষত এশিয়ায় ভিয়েতনামে জনগনের বিরুদ্ধে মার্কিনী হামলা, আগ্রাসন ও যুদ্ধের পুরো সময়টাতে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডায় সবচেয়ে সফল অস্ত্র ছিল এসকল প্রচারণা। শ্রমিক নিপীড়িত কৃষক, শহর ও গ্রামের গরীব ও মধ্যেবিত্ত শ্রেনীর চিন্তাশীল অংশের প্রায় প্রতিটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সব সময়ই এই আক্রমণটা কাজে লাগিয়েছে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই সফল হয়েছে। কমিউনিস্ট আন্দোলন কখনই জবাব দিয়েছে, ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়না। বরং কমিউনিস্টরা নিজেদের নাস্তিক জ্ঞান করে পুলকিত হয়েছেন সেই উদাহরণই বেশী। সত্যি কথা এই যে, নাস্তিকতাই কমিউনিজম, এই ধারণা পোক্ত করার পেছনে কমিউনিস্টরাই মদদ জুগিয়েছে। মজহার বলেন, পরিষ্কার জানা দরকার কাল মার্কস কিংবা লেনিন কেউই নাস্তিক্যবাদী ছিলেন না এই অর্থে যে, ধর্মের প্রশ্নকে তারা সস্তা নাস্তিকতা দিয়ে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেননি। মজহারের মতে, আস্তিক-নাস্তিক দুটোই বিশ্বাস। বিশ্বাস দ্বারা আল্লা আছে কি নেই সেই বির্তকের মীমাংসা হয় না, আল্লার ধারণা জগৎ থেকে মুছেও যায় না। বাংলাদেশে বির্তকটা এতো নিম্ন স্তরে পৌছে গেছে যে, নাস্তিকতা এখনো প্রগতিশীলতা বলে গণ্য। অথচ শ্রেণী সংগ্রামের দিক থেকে নাস্তিকতা আর প্রগতিশীলতা এক কথা তো নয়ই, এমনকি তাদের সর্ম্পক অতি ক্ষীণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য ও স্বঘোষিত নাস্তিকতা ভয়ংকর প্রতিক্রিয়াশীল অন্তত একটি কারণে যে, ওর মধ্য দিয়ে কোন দার্শনিক উপলদ্ধি বা জ্ঞানের বিচার কখনই করা হয়না।
বাংলাদেশে স্বঘোষিত নাস্তিকতা বরং সমাজের বিপক্ষে দাড়াঁনোর সস্তা বাহাদুরি নিছকই নিম্নরুচির ব্যাক্তিতান্ত্রিক উগ্রতা। সমাজের শ্রেণী সংগ্রামে এই বাহাদুরি প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী ও শক্তিগুলোর কাজে লাগে। তারা এই ঘোষণাকে ধর্মের ওপর আঘাত বলে প্রচার করে।
মজহারের মতে, নাস্তিক্যবাদের দার্শনিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। নাস্তিক্যবাদ দাবি করে - আল্লা নাই, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। ধর্মের এই বিবর্তন বিচারের সঙ্গে আল্লা আছে, না নেই , এই ফালতু বির্তক অপ্রাসঙ্গিক। র্কাল মার্কস সেই বিতর্কে কখনই জড়াননি। কাজের মানুষ হিসেবে লেনিন, মাও জে দং কাউকেই এই বেহুদা বির্তকে সময়ক্ষেপ করতে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই, লেনিন ধর্মকে মোকাবিলা করার নীতি ও কৌশল জানা ও বস্তুবাদী পদ্ধতিতে ধর্মের ব্যখ্যা হাজির করার ওপর গুরুত্ব দেন। এদিক দিয়ে লেনিনের জুড়ি নেই।
মজহার বলেন, ভয় আর আতঙ্কই ঈশ্বর তৈরী করে। এই ভয় হল পুঁজির অন্ধ শক্তির প্রতি ভয়। মজহারের মতে মার্কস ধর্মের সমালোচনার কথা বলছেন না, বলেছেন পর্যালোচনার কথা। সমালোচনা বলতে আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে সমালোচনার বিষয়কে পুরোপুরি নাকচ করে দেয়া। কোন কিছুকে আগাগোড়া নিন্দা করার জন্য আমরা সমালোচনা করি। সেটি ঠিক নয়। অথচ সমালোচনা সম্পর্কে এটাই আমাদের সাধারণ ধারণা। ধর্মকে নাকচ করার জন্য এবং আগাগোড়া নিন্দা করার জন্য ধর্মের সমালোচনা করা হয়। ধর্মের সমালোচনা করলেই সেটা প্রগতিশীল ব্যপার হবে, তার কোন মানে নেই। ধর্মের পর্যালোচনার মধ্যে দিয়ে ওর মধ্যে থেকে চিন্তার শাঁসটাকে বের করে আনতে হবে, একাট্টা ধর্মকে নাকচ করে নয়। এটাই হল মার্কসের পদ্ধতি। মার্কস লিখেছেন ‘‘ ধর্মহীন সমালোচনার ভিত্তি হচ্ছে মানুষ ধর্ম তৈরী করে - ধর্ম মানুষকে তৈরী করে না। আসলেই সেই মানুষ এখনো নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়নি কিংবা পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে, ধর্ম হচ্ছে সেই মানুষের নিজের সম্পর্কে চৈতন্য তার নিজের গৌরব চেতনা। (মার্কস ১৯৭৫, পৃঃ ২৪৪)
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ধর্ম মানেই কিছুনা, একটা ভুয়া ব্যপার বা ভুয়া চেতনা এই রকম কোন কথাই মার্কস এখানে বলছেন না - এবং কখনো মার্কস ধর্ম সম্পর্কে এই রকম উন্নাসিক মন্তব্য করেননি। এই কথাটা জোর দিয়ে বলার দরকার আছে। কারণ ধর্ম ভুয়া বা অর্থহীন একটা ব্যাপার। এই কথা গুলোর সঙ্গে প্রায়ই কমিউনিস্টদের যুক্ত করা হয়। কমিউনিজমের দুশমনরাই কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এই কথা প্রচার করে। অথচ দুশমনদের কাতারেই বরং থাকে ধর্মবিরোধী শোষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নানান ধারা। বাজার অর্থনীতির ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠার পাশাপাশি উন্নাসিক ধর্ম বিরোধিতা বেড়ে যায়। এর কারণ হল পুঁজিতন্ত্র ও বাজার ব্যবস্থা ব্যক্তির মধ্যে যে স্বার্থপরতার জন্ম দেয় তার ফলে ব্যক্তি দেখে যে তার লোভ, কাম, মোহ, আত্মতৃপ্তি ও স্বেচ্ছাচারিতা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে ধর্ম একটাই বাঁধা। কারণ সকল ধর্মই কিছু আচার ও নীতির উপর নির্ভরশীল।
ধর্মের জন্য মানুষের যে কাতরতা এবং কষ্ট, তাকে মার্কস বাস্তব সত্য হিসেবে দেখেছেন, কোনো ভুয়া চেতনা বা বিভ্রান্তি হিসাবে নয়। "ধর্ম জনগণের আফিম" ধর্ম সম্পর্কে কার্ল মার্কস এবং কমিউনিস্টদের ভাষ্য হিসেবে এই কথাটা নানানভাবে বিকৃত করে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আফিম হচ্ছে ব্যথা নিবারক অসুখে নিরাময় সাধন করার সাধ্য এই বেদনা নাশকটির নেই। যে পরিস্থিতি ও দুঃখ-দুর্দশা ব্যথার কারণ সেই খোদ ব্যবস্থাটাকে না বদলালে ব্যথা থেকে মুক্তির উপায় নেই। বিরাজমান অবস্থার জন্য মানুষ যে কষ্ট এবং কাতরতায় ভোগে তার হাত থেকে সাময়িক নিস্তার পাওয়ার জন্য ধর্মের আশ্রয় খোঁজে। বেদনানাশক হিসেবে আফিম যেমন ব্যথা দূর করে ধর্মও সাময়িক কাতরতা কমায় কিন্তু সেটাতো সমাধান নয়। বেদনা নাশকের উপর ক্রমাগত নির্ভরশীলতা ও পরিণত হয় ধর্মাসক্তিতে। আফিম কথাটি একেবারেই প্রতীকি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
মজহার বলেন, আল্লার অস্তিত্ব অস্বীকার ও কমিউনিস্টদের নাস্তিকতায় বিশ্বাস নিয়ে এতো বেশী ভুয়া প্রপাগান্ডা ও মিথ্যা জমেছে যে, সেই সব ময়লা আবর্জনা ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে না পারলে আমরা বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতি ও সংস্কৃতির ধারাকে শক্তিশালী করতে পারবো না। তিনি বলেন, প্রগতিশীলতা নামে আমরা বাংলাদেশে যে ধরনের নাস্তিক্যবাদের ভাঁড়ামি দেখি কিংবা ধর্ম বা "মৌলবাদী" শক্তির বিরোধীতার নামে এখনো যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে তার সাথে লেনিন বা মার্কসের কোনো যোগ নেই।
মার্কসের উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়ে ফরহাদ মজহার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, কমিউনিস্ট পার্টি মানে নাস্তিকদের পার্টি নয়। আল্লায় বিশ্বাসী ও ধর্মপ্রাণ খেটে খাওয়া মানুষ অবশ্যই কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হতে পারে। ঈশ্বর বিশ্বাসী ও খ্রিস্টান যদি লেনিনের বলশেভিক পার্টির সদস্য হতে পারে তাহলে বাংলাদেশে নিশ্চয়ই একজন মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসা মক্তবের ছাত্রও তার ধর্মীয় বিশ্বাসসহ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে পারে। সদস্য হতে পারে যে কোন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ যিনি শ্রমিক শ্রেণী ও গরিবের পক্ষ হয়ে ধনী শোষক শ্রেণীর বিরদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আপসহীন ও সংকল্পবদ্ধ।
মজহার বলেন, মার্কসের অনেকগুলো থিসিসের মধ্যে শুধু ১১ নম্বর থিসিসটাই বাংলাদেশের বিপ্লবীরা পড়েছে ও মুখস্ত করেছে। অন্যগুলো না পড়ার কারণেই বিপ্লবী রাজনীতির বিচ্যুতি ঘটেছে। শুধুমাত্র নিজেকে কমিউনিস্ট ঘোষণা দিলে কিংবা কমিউনিস্ট সাইনবোর্ড টানালেই যে কেউ কমিউনিস্ট হয়ে যায় না- এই সত্যটুকু আড়াল করার জন্যই মার্কসের চিন্তার চর্চা ও প্রয়োগের প্রচ্ছন্ন ও সক্রিয় বিরোধীতা বাংলাদেশে প্রবল। এর ফলে ৬০ বা ৭০ দশকের পাঠচক্রগুলো ক্রমশ ম্রিয়মান হয়ে একসময় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তিনি আক্ষেপ করেছেন এই জন্য যে, একটি পত্রিকা বা পাঠচক্র সংগঠিত করবার ক্ষমতা নেই অথচ নিজেদের কমিউনিস্ট পার্টি বলতে এখন কেউ আর লজ্জা বোধ করে না। তিনি বলেন, মার্কসের থিসিসের দোহাই দিয়ে চিন্তা বা জ্ঞান চর্চার বিরুদ্ধে এই সকল প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্যে বিরোধীতিার শেষ কবে হবে বলা মুশকিল। অন্যদিকে বিপ্লবী চিন্তার চর্চা এড়িয়ে যাবার কারণে বামপন্থিদের সব সময়ই লোকতুষ্টিকর, হালকা ও স্লোগান সর্বস্ব রাজনীতির উপরই নির্ভর করতে হয়।
প্রকৃতপক্ষে মোকাবিলা গ্রন্থে ফরহাদ মজহার কমিউনিজমের ত্রুটিগুলো তুলে ধরেছেন। কি কি ভুলের কারণে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং কিভাবে এই ব্যর্থতা মোকাবেলা করা যেত সেটিই তিনি তার মোকাবিলা গ্রন্থে সুনিপুণ ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।
সমালোচনা :
আলাপের বিষয় ফরহাদ মজহার-এর গ্রন্থ ‘মোকাবিলা’। মনে পড়ে, এই স্বাধীন বঙ্গদেশে মোকাবিলা আরেকটা হয়েছিল। ‘ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্র’ নামক নাইভ সেই মোকাবিলাটির উদ্গাতা কমরেড মোজাফফর আহমদের ন্যাপ পার্টি। সেটা দার্শনিক মোকাবিলা ছিল না, বড়জোর ছিল একটা রাজনৈতিক কৌশল এবং ব্যর্থ। সত্তরের দশকের শেষদিকে এই আওয়াজ তুলেছিল ন্যাপ পার্টি, আর আশি পার হতে-না-হতে তো সমাজতন্ত্রেরই দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা! তো, এই বর্তমান সময়ে যিনি আলোচনা করছেন তিনি ফরহাদ মজহার এবং তার বয়ানের ধরন মোটেও সমাজতন্ত্রের পোস্টমর্টেম গোছের কিছু নয়। বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের যবনিকা নিয়ে তার বিষণœতা নেই, মোটেও হতাশ নন তিনি তার কমিউনিস্ট পরিচয় নিয়ে। দু’শ পৃষ্ঠার এই বইতে ফরহাদ মজহার ধর্ম, ধর্মনিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা ইত্যকার বিষয়ের সাথে সমাজতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রীদের মোকাবিলার ধরণটি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। সেসব তিনি বলেছেন মুখ্যত মার্কস আর এঙ্গেলসকে হাজির নাজির রেখে। তিনি দেখিয়েছেন, ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের যে বিখ্যাত ‘আফিম’ উদ্ধৃতি যুগ যুগ ধরে চলছে, তাকে পূর্বাপর বিবেচনা করলে সেটা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। ধর্মের অবসানের জিগির মার্কস তোলেন নি, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি ধর্মেও মীমাংসা বলে মানেন নি। আর এঙ্গেলস তো বিকশিত হয়ে থাকা খ্রীস্টধর্মকে সমাজতন্ত্রেরই একটা রূপ বলেছেন প্রকারান্তরে। আরো বলেছেন, ১৮০০ বছর ধরে যে জিনিস সভ্য দুনিয়ার একটা বিরাট অংশের ওপর আধিপত্য চালিয়েছে (অর্থাৎ খ্রীস্টধর্ম) তাকে অর্থহীন বেকার জিনিসের স্তুপ বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। অথচ তাকে উড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদেরই অনুসারীরা! কালেক্রমে তাদের কাছে কেশর দোলানো নাস্তিক্যই হয়ে দাঁড়াল কমিউনিস্ট হবার পূর্বশর্ত! কেন সেটা হল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে, সেটা স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। কিন্তু স্বতন্ত্র হলেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান যেভাবে ইসলামকে ব্যবহার করে বাঙালিদের শোষণ নির্যাতন করেছে, সেই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হল তখন তার রাষ্ট্রীয় অন্যতম
স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কিছুটা হলেও ইসলামের ভূমিকাকে উৎখাত করা অর্থে বুঝেছি আমরা। আর সমাজে ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি ও ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব তো ছিলই। সেই দ্বন্দ্ব কমে নি একটুও, বরং বেড়েছে গোকুলে, আর তার তোড়ে খড়কুটোর মত ভেসে গিয়েছে আমাদের জাতীয় ঐক্য। ফরহাদ মজহার তাই বলেন, একপক্ষের ত্রিশূল আর অন্য পক্ষের তলোয়ারের তলে মাথা রেখে এখন ধর্ম নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আলোচনা করতে হয়। আবার ধর্ম নিরপেক্ষতাকে এই দেশে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক হিসেবে না দেখে একটা ‘সাংস্কৃতিক’ উপাদান হিসেবে দেখা হয়েছে, যেন এই দেখনদারির মধ্যেই ‘আবহমান বাঙালি’র আত্মপরিচয় আছে। ফলে অনেকের কাছে ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া মানে হয়ে দাঁড়াল বাঙালি হওয়া, আর বাঙালি হওয়া বলতে তারা যা বোঝেন তার সাথে উপনিবেশিক কলকাতার উচ্চবণের্র হিন্দুদের আচার-সংস্কৃতির ফারাক যে নেই সেটা ফরহাদ মজহার বলেছেন। যা ছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রকৌশল, সিভিল সমাজে তার অনুবাদ হল অন্যরকম। কার্ল মার্কস এজন্যই বলেছিলেন, বেহেশতের সাথে দুনিয়ার সম্পর্ক যেমন আধ্যাত্মিক, ঠিক তেমনি আধ্যাত্মিক রাষ্ট্রর সাথে সমাজের সম্পর্ক! ধর্ম প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার মার্কস-এঙ্গেলসের পরে যার কথা সবচে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি লেনিন। লেনিনের মতে, ধর্ম গরিব মেহনতি শ্রমিকের ওপর ভর করতে সক্ষম হয় এজন্য যে, পুঁিজতন্ত্রের অন্ধশক্তির সামনে সাধারণ মানুষ অসহায় বোধ করে। এই ভয় আর পুঁজির চলাচলের পূর্বাপর অনুমান করতে না-পারাই ঈশ্বর এবং ধর্ম তৈরি করে। ফলে, সমাজ থেকে পুঁজিতন্ত্রের বিনাশ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মের বিনাশ হবে না। সস্তা নাস্তিক্যবাদী ‘কের্দানি’ দিয়ে মানুষকে আরো বিপন্নই কেবল করে তোলা যাবে। ফরহাদ মজহারের মতে, সেটাই করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা। প্রশ্ন ওঠে, এই অভিযোগ যিনি করছেন তিনি কে? কোথায় দাঁড়িয়ে তিনি তুলছেন তার তর্জনী? ফরহাদ মজহার বলছেন তিনি একজন কমিউনিস্ট, কিন্তু সমাজ যেভাবে একজন কমিউনিস্টকে চিনেছে এবং বিচার করেছে তিনি সেই মাপে কমিউনিস্ট নন। তার মতে, সোভিয়েতের পতন বা পূর্ব ইউরোপের ভাঙ্গনের ফলে বিষয়টি আরো সহজ হয়েছে তার কাছে। ‘যারা কমিউনিজমকে কোনো ‘মত’ বা ‘ধর্ম’ নয়, মানুষের চিন্তা ও তৎপরতা বিকশিত হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে গ্রহণ করেন তাঁরা এখন নিজেদের কমিউনিস্ট বলতে পারবেন অনেক সহজে। এই কমিউনিস্ট পরিচয়ের সাথে আধ্যাত্মিকতা কিংবা ধর্মেও কোনো সংঘাত নেই। এই কমিউনিস্ট সহজ মানুষের ধ্যানের মধ্যেই বাস করে, এবং বিকশিত হয়। তার লক্ষ্য মানুষের সার্বিক মুক্তি, শোষণ বঞ্চনার অবসান। ধর্মেরও লক্ষ্য তাই। ফরহাদ মজহারের এই চিন্তাকে নিছক তত্ত্বকথা বলার সুযোগ খুব নেই, প্রথমত তিনি নিজে এর আমল করেন বলে জানা যায়। আর দ্বিতীয়ত, ইন্দোনেশিয়ায় ‘ইসলামিক লেফট’ নামে যে বিপ্লবী গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে, তাদের উদ্ভাসের পেছনেও ফরহাদের মজহারের তত্ত্বের যৌক্তিকতাকে হাজির করা যায়। ফরহাদ মজহার নিজেও জানিয়েছেন যে, লাতিন আমেরিকায় লিবারেশন থিওলজির সাথে মার্কসবাদীদের আলাপ আলোচনা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষিতেই ‘রিলিজিয়ন এন্ড দি লেফ্ট’ প্রবন্ধে কর্নেল ওয়েস্ট লিখেন যে, ধর্মের প্রশ্নে মার্কসবাদীদের মধ্যে ইউরোপীয় এনলাইটমেন্টের বরাবরে তৈরি ধরো-তক্তা-মারো-পেরেক নীতির দিন ফুরিয়ে গিয়েছে।
যে-কয়টা যুক্তি হাজির আছে এই বইতে, সেটির পুরো উদঘাটন এই অল্পদৈর্ঘের আলোচনায় সম্ভব নয়। নানা বিষয়ে বিস্তারিত বুঝবার, শুনবার এবং বলবার আছে। যেমন, প্রশ্ন জাগে, কেন জগতের গরিব মানুষগুলো মার্কসের কাছে বিপ্লবী দর্শন ফলিয়ে তোলার কাজটি পেল, অথচ নিজেরা দর্শন তৈরির ভারটি পেল না ? তাদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা বিষয়ে ‘অবিশ্বাসী ও উন্নাসিক’ থাকা ইউরোপীয়
এনলাইটমেন্টের ‘জন্মগত অসুখ’ হতে পারে মানলাম, কিন্তু মার্কসবাদের সাথে তার বোঝাপড়া কিভাবে হবে? যেহেতু এই বোঝাপড়া বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনীতি পুনর্গঠনের প্রাথমিক পরিবেশ তৈরি করতে পারে সেটা ফরহাদ মজহার জোর দিয়ে বলছেন। বাংলা ভাষায় এই মাপের একটি চিন্তা উদ্রেককারী গ্রন্থ খুব কমই লেখা হয়েছে। আবার সেটা নিছক গ্রন্থরচনাবিলাস থেকেও রচিত হয়নি, হয়েছে জরুরি দার্শনিক বোঝাপড়ার জায়গা থেকে। ফরহাদ মজহার জোরদিয়ে বলেছেন যে, ধর্মের প্রতি বিপ্লবী রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি আশপাশের পেটিবুর্জোয়া মতাদর্শ থেকে আলাদা হতে হবে। ধর্মকে যেমন আমরা নিছক আলাহ ও শয়তানের লড়াই হিসাবে দেখব না, তেমনি শ্রেণীসংগ্রামকেও আমরা শয়তানরূপী বুর্জোয়া এবং ফেরেশতারূপী শ্রমিকের লড়াই হিসাবে দেখব না। দুটোই ধর্মতত্ত্বের এপিঠ ওপিঠ। তাহলে বিপ্লব কী? বা ধর্মই বা কী? কিংবা বিপ্লবের ধর্ম বা ধর্মের বিপ্লব বলতেই আমরা কী বুঝব? ফরহাদের জবাব হচ্ছে: শয়তানের বিপরীতে শুভকে ব্যাখ্যা, বর্ণনা বা ধারণা করা নয়, বরং শুভ কি, সেই প্রশ্নকে শয়তান বা অশুভের ধারণা থেকে পৃথকভাবে ভাববার শক্তি অর্জন করা’ । বইটির পাঠ শেষ হবার পর প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায় যে, কেন আমাদের কমিউনিস্ট বিপ্ল¬বীরা ‘ধর্মহীনতা’ বা ‘নাস্তিক্য’কে শিরোধার্য করেছিলেন? সেটা কি নিছক বস্তুবাদী দার্শনিক বোঝাপড়ার জায়গা থেকে? নাকি এর পিছনে নানান আর্থ-সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রণোদনাও ছিল? আর নাস্তিক্যের শিরোপা যারা পড়েন নি, সেই কমিউনিস্টরাই কেন বা এমন একটি ‘পুঁজিবাদী প্রচারণা’র বিপক্ষে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারলেন না?
তথ্যসূত্র: মোকাবিলা , ফরহাদ মজহার
ধর্ম এবং বিপ্লবীর বোঝাপড়া: ফরহাদ মজহার (পর্যালোচনা, সুমন রহমান)